আলোকচিত্রী সাইদা খানমের চোখে বঙ্গবন্ধু
সভ্যতার শুরু থেকেই বারবার মানবতা হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। শোষক ও
শোষিতের ব্যবধান বেড়েছে। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে শোষণের মাত্রা—হোক তা প্রাচ্য
বা তার বিপরীত গোলার্ধ। তাই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের উপর অমানুষিক নির্যাতন বন্ধে,
মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন পড়েছিলো একজন মার্টিন লুথার কিং
বা ম্যালকম ম্যাক্সের। ঠিক তেমনি বাঙালিদের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের
প্রতি সীমাহীন বৈষম্য রোধ করতে দরকার হয়েছিলো একজন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এক
মহানায়কের।
বঙ্গবন্ধু , মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশ
শব্দগুলো একে অপরের পরিপূরক বা পরিবর্তক শব্দ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। আপেক্ষিক বিচারে
শব্দগুলোর গভীরতা অনুধাবন করে পার্থক্য খোঁজে বের করা অনেকটাই দুষ্কর। বঙ্গবন্ধু
থেকেই মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ থেকে বাংলাদেশ । সেই সূত্রে শব্দগুলো একই সূত্রে
গাঁথা। স্বনামধন্য লেখক আহমদ ছফা তার শেখ মুজিবুর রহমান নামক প্রবন্ধে লিখেছেন,
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার
পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত
পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে।’
স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি। তাই বঙ্গবন্ধু ও
বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য নাম। যতদিন বাংলার মানচিত্র থাকবে, যতদিন বাঙালির ইতিহাস
থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন অমর-অবিনশ্বর। বাংলার স্বাধীনতা, ভাষা, সমাজ,
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালিরূপে বঙ্গবন্ধু থাকবেন চিরজাগ্রত।
রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা ইউএসবি’র (USB) ভাষায় বঙ্গবন্ধু `World political poet’।
এই মহানায়ককে যারা কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, সান্নিধ্য পেয়েছেন তাদের একজন আলোকচিত্রী সাইদা খানম। আলোকচিত্রী
হাওয়ার সুবাদে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তখন ক্যামেরা থাকলে
সরকার প্রধানের যে কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ ছিল, সুবিধা ছিল। এতো সিকিউরিটি ছিল
না। সাইদা খানম এই মহান ব্যাক্তিকে ধারণ করেছেন, চিত্রায়ণ
করেছেন তার তার ক্যামেরার ফ্রেমে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান পিজি হাসপাতালে
ভর্তি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তিনি তাঁর বাবাকে হাসপাতালে দেখতে যান। এসময়
সাইদা খানম বাবা ও ছেলের মিলনের ছবি তুলেন।বাবা-ছেলের মিলনের ছবিটা অনবদ্য হয়ে
ওঠে। বঙ্গবন্ধুর এই ছবি তুলতে গিয়ে তার মনে হয়েছে , তিনি সূর্যকে
ক্যামেরায় ধরে ফেলছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই আন্তরিক। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ছিল
খুবই মনোমুগ্ধকর। আমি প্রায়ই ক্যামেরা নিয়ে যেতাম তার কিছু ছবি তোলার আশায়।
ছবির এই মুহূর্তকে আলোকচিত্রী সাইদা খানম দারুণভাবে
ক্যামেরা বন্দি করেছেন। ছবিটিতে মুহূর্তটির আবেদন ও আবেগ যথাযথভাবে ধারণ করতে পেরেছেন।
এটাই একজন দক্ষ আলোকচিত্রীর গুণ। সাইদা খানমের হাতের ক্লিকে মুহূর্তটি আরো প্রাণবন্ত
হয়ে ধরা দিয়েছে তার ক্যামেরার ফ্রেমে। ছবিটার
বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে যে
বঙ্গবন্ধু তার অসুস্থ পিতাকে দেখতে এসেছেন। বাবার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। বাবাকে কিছু
বলে সান্ত্বনা বা সাহস দিচ্ছেন। কিন্তু এর মধ্যে আরো অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে
দিয়ে বাবা ছেলের যে অনবদ্য সম্পর্ক তা ফুটে উঠেছে। অসাধারণ ফ্রেমের এ ছবিটি
বাবা-সন্তানের মধ্যকার নির্ভরতা ও ভালোবাসার সম্পর্কের এক অনবদ্য চিত্ররূপ।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক
জীবনের নানা সংকটে বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন এক নির্ভরতা ও আশ্রয়ের জায়গা।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাবার কিছু উপদেশের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি
লিখেছেন,
“দিন রাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী।
আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন। ‘বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য
সংগ্রাম করছো, এতো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না। আরেকটা কথা
মনে রেখ- sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না’।
আব্বার একথা কোনদিন আমি ভুলি নাই”।
পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা
‘দায়িত্বশীলতা’ ও ‘দেশপ্রেম’ এই দুটি শব্দকে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত করেছেন পুরো
জীবনে। সাইদা খানম এই ছবিতে দেখিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু ছেলে হিসেবে বাবার
প্রতি কতটা দায়িত্বশীল। খুব ভালো একটি এ্যাঙ্গেল থেকে তাঁর পোর্ট্রেটটি তুলেছেন। এতে করে তার বাবার চেহারার যে বিভিন্ন অক্ষর,
বঙ্গবন্ধুর চেহারার মধ্যে যে ব্যক্তিত্ব, তার উদার কণ্ঠ, চোখের যে ঝিলিক, যখন সে
কথা বলে সবকিছুই দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। সাইদা খানমের চোখে বঙ্গবন্ধু এখানে দায়িত্বশীল
একজন ছেলে যিনি জন্মদিনের নানা আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে অসুস্থ বাবাকে দেখতে এসেছেন।
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি তার বাবার চেহারায় এক প্রকার প্রশান্তি অনুভব তৈরী করেছে।
বাবা শেখ লুৎফর রহমান এর মত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণেরও ভরসার জায়গা এই বঙ্গবন্ধু।
বাবার মত জনসাধারণও তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভরসা খুঁজে পেয়েছিল।
তথ্যসূত্র :
প্রথম আলো . (৩১, ৭ ,২০১৩). দেশের প্রথম
নারী আলোকচিত্রী . Retrieved from
http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2011-11-11/news/199992
দৈনিক ইত্তেফাক . (৮, ০২ ,২০১৭). নারী
আলোকচিত্রীর আলোকবর্তিকা . Retrieved from http://archive1.ittefaq.com.bd/print-edition/pothikrit/2017/02/08/174379_print.html

No comments