সাইদা খানমের চোখে সুচিত্রা সেন








সুচিত্রা সেন নামটি নিলেই যে অনিন্দ্যসুন্দর অবয়ব ভেসে ওঠে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যাকে। ছিলেন অভিনয়, ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যের মিশেল। তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ প্রতিটি বাঙালিহূদয়। স্নিগ্ধতা আর দৃঢ়তা—দুইয়ের মিশেলেই তাঁর সৌন্দর্য। তাঁর রূপের ছটায় প্রকাশ পায় একধরনের আত্ম-অহংকার, প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং স্বাভিমান। সেই সময়ে সুচিত্রা সেনের স্টাইল ছিল আধুনিক, আবার এই সময়ের অনেকের কাছেও সুচিত্রা সেনের আবেদন কম নয়।
বাংলাদেশের পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে করুনাময় দাশগুপ্ত আর ইন্দিরা দাশগুপ্তের পরিবারে জন্ম রমা দাশগুপ্তের। শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় পাবনার আলো-হাওয়াতেই কেটেছে রমার। পাবনার মহাখালী পাঠশালার পাঠ শেষ করে পা দেন পাবনা গার্লস স্কুলে; দশম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই।

এরপর দেশভাগ আর দাঙ্গার শিকার হয়ে আরো অনেক হিন্দু পরিবারের মতো রমার পরিবারও পাড়ি জমায় কলকাতায়। সেটা ১৯৪৭ সালের কথা। ওই বছরেই কলকাতায় থিতু হওয়া ঢাকার আরেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার। নামের শেষে স্বামীর উপাধি যোগ করে হয়ে তিনি হয়ে যান রমা সেন।


আলোকচিত্রী সাঈদা খানমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাবনা শহরেই। রমাদের দুই বাড়ি পরেই থাকতেন সাঈদা খানম। সাঈদা খানমের বড় বোনের সাথে প্রায়ই আসতেন তাঁদের বাসায়। তিনি সুচিত্রা সেনকে নিয়ে তাঁর ‘স্মৃতির পথ বেঁয়ে’ বইতে বর্ণনা করেছেন এইভাবে- ‘‘রমাদের বাড়িতে গিয়ে শুনি ওরাও পাবনা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রমা পাবনা স্কুলে পড়াশোনা করে শান্তিনিকেতনে চলে যায়। তারপর ফিরে আসে। রমা তখন মুগ্ধ করার মতো সুশ্রী তরুণী। রমার একটা দৃশ্য দেখে বইতে ছাপা শকুন্তলার কথা মনে হয়েছিল। আজকাল ব্লাউজবিহীন কাঁচুলি পরা সুন্দর দেহের ছবি বইতে, সিনেমা ও বাস্তবে দেখি। কিন্তু সেই যুগে দেখি ওর কাঁচুলি বেঁধে দিচ্ছে ওর বড় বোন উমা। তখন আমার হাতে ক্যামেরা ওঠেনি, কিন্তু দৃশ্যটা ছিল ছবি তোলার মতো। পাবনা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে পাশের বাড়ির কৃষ্ণার সঙ্গে আমাদের বাড়ি এসেছিল’’।

সুচিত্রার চাহনিতে ছিল স্বচ্ছ গভীরতাবাঙালি কবিরা একেই বোধ হয় বলেন ভুবনমোহিনী হাসি। যতবার পর্দায় তাঁর হাসিমুখ ভেসে উঠেছে, তরুণ বাঙালি-দর্শকের হূৎকম্প থেমে যায় একটুক্ষণের জন্য! বেণি করে ফিতায় জড়ানো খোঁপার সাজ আর রং মেলানো ছাপা শাড়ি-ব্লাউজের স্টাইলও দারুণ পছন্দ তাঁদের। ছোট্ট দুলের সঙ্গে বড় লকেটযুক্ত গলার চেন পরার স্টাইলও বোধ হয় তাঁকে দিয়েই শুরু হয়েছিল। সুচিত্রার চিবুকের তিল, সুবিন্যস্ত দাঁত, টিকালো নাকের থেকেও দর্শক ভালোবেসেছিলেন তাঁর বাঙ্ময় চোখ আর সেই চোখের ভাষা। পরিচালক সুকুমার রায় একবার তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওর চোখ দুটি বড় সুন্দর আর এক্সপ্রেসিভ, চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা, মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উচ্ছলতায় ভরে যায়। একনজরেই পছন্দ হয়ে যাওয়ার মতো।’

প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী এবং ফ্যাশনেবল ছিলেন তিনি। ঝোলানো দুল, কপালের টিপ আর জর্জেট শাড়িতে তাঁকে মনে হয়েছিল স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা; কিংবা সপ্তপদী ছবিতে মোটরসাইকেলে গাওয়া ‘এই পথ যদি না শেষ হয়...’ গানে তাঁর উড়তে থাকা ছোট চুল, বড় সানগ্লাস আর স্কার্ফ জন্ম দিয়েছিল নতুন ট্রেন্ডের। সেই ছবির অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রিনা ব্রাউন হয়ে উঠেছিলেন তখনকার ফ্যাশনের প্রতিমূর্তি। হাতে আঁকা ভ্রু আর ঘন করে দেওয়া কাজলেও যেন মায়াময়তার থেকে রহস্যময়তাই বেশি নজরে আসে। ছোট করে টিপ পরতেন। থ্রি-কোয়ার্টার হাতার কাজ করা ব্লাউজ, শাড়িতে লেস এমনকি শুধু পনিটেইল করে চুলকে সামনে নিয়ে আসার স্টাইলে পঞ্চাশের দশকেও সুচিত্রা পুরো আধুনিক। টেনে খোঁপা করে কপালের ওপর কয়েক গাছি চুল ফেলে রাখার ফ্যাশনও তাঁর হাত দিয়েই শুরু। শাড়ি পরার স্টাইলেও ছিল ভিন্নতা। একটু একপেশে কুঁচি এবং আঁচলটাকে টেনে সামনে নিয়ে এসে কোমরে গুঁজে দিতেন (খান, ২০১৪)।

শাপমোচন, চন্দ্রনাথ, ত্রিযামা, ইন্দ্রানী, পথের দাবী—যে চলচ্চিত্রের কথাই বলা হোক না কেন, তাঁর স্টাইল, ফ্যাশন, সৌন্দর্য এককথায় আইকনিক। আটপৌরে বাঙালি নারীও যে কতটা আবেদনময় আর অনন্য হয়ে উঠতে পারে, সুচিত্রা যেন তাঁর প্রকৃত উদাহরণ।    
১৯৫৫ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় হিন্দি ‘দেবদাস’ ছবিতে দীলিপ কুমারের বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ পান সুচিত্রা। ‘পার্বতী’ চরিত্রে তার অভিনয়ে বিমোহিত হয় দর্শক। এ ছবি তাকে এনে দেয় জাতীয় পুরস্কার। এসময়েই কলকাতায় গিয়ে সুচিত্রা সেনের সাথে দেখা করেন সাঈদা খানম। তাঁর কয়েকটি ছবি তুলেন চিত্রালী ম্যাগাজিনের জন্য।
আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সুচিত্রাকে। একে একে অভিনয় করেন শাপমোচন, সাগরিকা, পথে হলো দেরি, দীপ জ্বেলে যাই, সবার উপরে, সাত পাকে বাঁধা, দত্তা, গৃহদাহ, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্তর মতো দর্শকপ্রিয় সব ছবিতে।

‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৬৩ সালে ‘মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে’ সেরা অভিনেত্রীর সম্মান পান সুচিত্রা। ভারতীয় কোনো অভিনেত্রীর জন্য সেটিই ছিল বড় মাপের প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার।   

চলচ্চিত্রে অধিকাংশ সময়ই সুচিত্রার সহঅভিনেতা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছাড়া সে সময় কোনো ছবি ‘হিট’ হবে, এটা ভাবা নির্মাতাদের জন্য কঠিন হতো। সাঈদা খানম উত্তম কুমারের ইন্টার্ভিউ নিয়ে গিয়েছিলেন। সুচিত্রা সেন সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই বলেন, ‘‘ওর সঙ্গে অভিনয় করতে ভালো লাগে। আমরা পরস্পর পরস্পরকে বুঝতে পারি’’(Malik, 2014)
১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয়ের পর চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। অভিনয় জীবনের পুরোটা সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা মানুষটি ছিলেন তার নিজের এবং পরের দুটি প্রজন্মের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। একান্ত ব্যক্তিগত চিকিৎসক, হাসপাতালের নার্স, পত্রিকার সাংবাদিক কেউ তার অন্তরালে থাকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি কখনো। তিন যুগের স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিজের চারপাশে রহস্যের জগৎ গড়ে তুলেছিলেন

কৃতজ্ঞতাঃ মুহাম্মদ খাইরুযযামান 

তথ্যসূত্র
খানম, সাঈদা (২০১৩)। স্মৃতির পথ বেঁয়ে। পৃষ্ঠাঃ ৩৬। ঢাকাঃ যুক্ত প্রকাশনী
খান, কানিজ আলমাস (২১ জানুয়ারি, ২০১৪)। সুচিত্রা সাঁজে আজও। দৈনিক প্রথম আলো। সংগৃহীতঃ https://www.prothomalo.com/life-style/article/127672
Shadma, Malik (18th January, 2014). Suchitra was a true beauty, recalls Syeda Khanam. Dhakatribune. Available at: https://www.dhakatribune.com%2Funcategorized%2F2014%2F01%2F18%2Fsuchitra-was-a-true-beauty-recalls-syeda-khanam

No comments

Powered by Blogger.