জহুরুল হক হলে গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা জানে না হল কর্তৃপক্ষ

জহুরুল হক হলে গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা জানে না হল কর্তৃপক্ষ

চিত্রঃহলের অতিথি কক্ষে শহিদদের ছবি। 

 
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এ শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) নিহত শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের প্রকৃত সংখ্যা জানেনা হল কর্তৃপক্ষ। মার্চের ঐ কালো রাতে ঢাকার যে কয়টি স্থানে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল অন্যতম। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় অর্ধযুগ পার হলেও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের মত একটি জাতীয় বিষয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রশাসনের নির্লিপ্ত মনোভঙ্গি।
২৫ শে মার্চ রাতে গণহত্যার পর,২৭ শে মার্চ সকালে হলে সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ঘুরতে আসেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংক। ২০১২ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড্রিংক বলেন, ঐ দিন সকালে তিনি নিজে জহুরুল হক হলে ৩০ জনের লাশ গুনেছিলেন। এবং করিডোরে টেনে নেওয়া লাশের রক্তের ছাপ দেখে তাঁর ধারণা কম করে হলেও ঐ রাতে ২০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ঠিক একই তথ্য পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বইয়ে। ড. মোহাম্মদ হান্ন‌নের লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বইয়ে বলা হয়েছে,“ ২৬ শে মার্চ সকালে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়ে, সেখানেই দেখা গেল লাশ’। জেনারেল টিক্কা খানের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়েও রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঐদিনকার গণহত্যার বিবরণ। গুগলে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণহত্যা’ কী ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করলে উইকিপিডিয়ায় একটি সমৃদ্ধ অনুচ্ছেদ পাওয়া যায়। সেখানে তথ্য নির্দেশিকাসহ ড. ক মুনিমের দেওয়া তথ্যে উল্লেখ করা হয়, আনুমানিক ২০০ জনের গণহত্যার কথা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হল অফিসে মাত্র নয় জনের একটি তালিকা পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৭ জন ছিলেন হলের তৎকালীন আবাসিক ছাত্র, বাকি দুইজনের একজন হলের নৈশপ্রহরী সামছুদ্দীন  ও অন্যজন হলের ক্যান্টিনব্যবস্থাপক আবদুল জলীল। জহুরুল হক হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানান, “তিনি ২০১৬ সালে তৎকালীন হল প্রাধ্যক্ষ ড. আবু দেলোয়ার হোসেনের সময়কালে এই তালিকাটি তৈরি করেন”।

চিত্রঃ দোতলার সিঁড়ি কোঠায় শহিদদের নামফলক।

অবশ্য এই তালিকা তৈরির বহু আগে থেকেই হলের মূল ভবনের দোতলায় উঠার সিঁড়ি বরাবর সাদা শ্বেতপাথরে কালো কালিতে লেখা তালিকাভুক্ত নয় জনের নামছিল। হলের অতিথি কক্ষেও তালিকাভুক্ত নয়জন শহিদের ছবি টানানো আছে।

চিত্রঃশহিদ সামসুদ্দীন ও শহিদ আবদুল জলিলের সমাধি। 
 
তাছাড়া, গণহত্যার সাক্ষ্য হিসেবে বর্ধিত ভবনের পতিত আঙিনায়ও দেখা মেলে শ্বেতপাথরে বাঁধানো দুটি কবর যার একটি হল নৈশপ্রহরীর ও অন্যটি হলের খাদ্য ব্যবস্থাপকের। কবরের চকচকে শ্বেতপাথরগুলো দেখেই বোঝা যায়, সম্প্রতি হল প্রশাসন এগুলোর কাজ করিয়েছেন।প্রতিবছর মার্চ মাস এলে অসংখ্য সাংবাদিককেই মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার উপর সংবাদ সংগ্রহের জন্য জহুরুল আসতে দেখা যায়। এই সাংবাদিকদের অনেকেই ঐ রাতের বিভীষিকা নিয়ে হলে চাকরি করা মুরুব্বী স্থানীয় কারো বাইট নিয়ে চলে যায়। ঐ সময়ে হলে চাকরিরত প্রত্যক্ষদর্শী যারা ছিলেন, তারা মোটামুটি ২০০০ সালের আগেই অবসরে চলে যান। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ’ এর সাবেক পরিচালক ও জহুরুল হক হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ ড. দেলোয়ার হোসেনের কাছে গণহত্যার ইতিহাস সংরক্ষণে হল প্রশাসনের উদাসীনতা আছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম।তিনি জানান,“এই বিষয়ে তাদের কোন উদাসীনতা নেই। অদূর ভবিষ্যতে এটা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করবেন”।তাছাড়া, স্বাধীনতার এতো বছর পর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ের কাজটি করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হবে বলেও জানান ড. হোসেন
কিন্তু মজার বিষয় হল, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে নিহত নয় জন শহিদের নাম ছাড়া অন্য কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও ১৯৫৫ সাল থেকে আজ অব্দি হলে দায়িত্ব পালন করা সকল প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে যোগদান থেকে শুরু করে দায়িত্ব ছাড়ার দিনক্ষণের খুঁটিনাটি তথ্যও রয়েছে হল প্রাধ্যক্ষের কার্যালয়ে।  
মুক্তিযুদ্ধের মত জাতীয় ইতিহাস সংরক্ষণে এমনই চিত্র দেখা যায় খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ,তরুণ প্রজন্মকে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় আগ্রহী ও উদ্বদ্ধু করতে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই চালু করা হয় ‘সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ’ নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান।  

No comments

Powered by Blogger.