শিশু শ্রমের চিত্র পাল্টায় নি, ব্যহত হচ্ছে মানব উন্নয়ন



                                শিশুশ্রমিক সাকিবের সাথে প্রতিবেদক

এই বয়সে হাতে থাকার কথা ছিল বই। অথচ এই হাতে করতে হচ্ছে কাজ। যে বয়সে কাঁধে নেওয়ার কথা ছিল স্কুল ব্যাগ সেই কাঁধে নিতে হচ্ছে পরিবারের বোঝা। যেই বয়সে বাবা মায়ের স্নেহ পাবার কথা সেই বয়সে নিতে হচ্ছে বাবা মায়ের দায়িত্ব। এর জন্য করতে হচ্ছ হালকা কাজ থেকে ভারি কাজ। তেমনি একজন শিশু বিপ্লব। বয়স কতই বা হবে! মাত্র ১০। রাজধানীর মিরপুর রোডে বিক্রি করে আঁখ। নিজেই প্রতিদিন ভ্যান চালিয়ে নিয়ে আসে হাজারীবাগ থেকে। কখনও রাস্তার পাশে আঁখ নিয়ে বসতে পারে। আবার কখনও পুলিশ তাদের বসতে দেয় না। প্রতিটি আখের পিস বিক্রি করে ১০ টাকা করে। প্রতিদিন বিক্রি করে পায় ৩০০-৪০০ টাকা। উপার্জনের পুরো টাকাই পাঠিয়ে দিতে হয় মায়ের কাছে। মা থাকেন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বারাইপাড়া গ্রামে। সে থাকে থাকে হাজারীবাগে চাচাতো ভাইয়ের সাথে। ‘‘ বাপে আরেক বিয়া করছে। আমাগো খবর লয় না। দুই ভাই বোন লইয়া মায় গ্যারামে থাকে। তাদের মাস শেষে টাকা দেওন লাগে। হেই কারণে কোন দিন স্কুলেও যাইতে পারি নাই’’ বললেন বিপ্লব। পাশেই চাচাতো ভাই অপু(১৪) বিক্রি করে ভুট্টা। অপু জানায়, ‘‘ দুইবছর আগে আমি ঢাকা শহরে আহি। আর বিপ্লব আহে ৬ মাস আগে। এরপরে আমি ওরে কামে লাগাই দিছি। যহন যেইডার দাম বেশি তহনি হেইডা বিক্রি করি আমরা’’।
                 
                       শিশু বিপ্লব। আঁখ বিক্রি করছে রাজধানীর মিরপুর রোডে

একই চিত্র শাহবাগ মোড়েও। সাগর ও সাকিব। দুজনের গায়েই জরাজীর্ণ পোশাক। লিকলিকে শরীর। একজনের বয়স দশ। আরেকজনের এগারো। দুজনেরই বাড়ি  কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সাইদপুরে। থাকে চকবাজারের পুরাতন মসজিদের কাছে। এতো অল্প বয়সেই বিক্রি করছে সিগারেট। প্রতিদিন বিক্রি করে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে। এর পুরোটাই নিয়ে নেয় তাদের মহাজন। সাকিব বলেন, ‘‘প্রতিদিন ভোর থেকে রাত ৮-৯ টা পর্যন্ত তার রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হয়। দিনে মালিক মাত্র ১৫০ টাকা করে দেয় আমাদের’’। দুজনেরই পরিবারে টাকা পাঠাতে হয়। সাগরের বাবা রিক্সা চালান ভৈরবে। দাদা-দাদি, বাবা-মা, ভাই-বোনসহ ৯ জনের পরিবার তাদের। এতো বড় পরিবার বাবার একার পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। সেজন্য সেও নেমে গেছে উপার্জনে। তবে সাকিবের গল্পটা ভিন্ন। আর্থিক অনটনে থাকলেও কৃষক বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে পড়াশোনা করাতে। পড়েছেও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। ছেলের পড়াশোনা আর ভালো লাগছিল না। তাই কাজ করতে চলে এসেছে শহরে।

  
              সাকিব ও সাগর। শাহবাগ মোড়ে বিক্রি করছে পান, সিগারেট

বাংলা একাডেমীর সামনের রাস্তা। সেখানে বসে মায়ের সাথে ফুলের মালা গাঁথছে রত্না। পাশেই আরও কয়েকজন বসে আছে। তারাও মালা গাঁথছে। এসব ফুলের মালাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে সাবিনা, বৈশাখীর মতো শিশুরা। কাছে এসে বলে, ‘‘ভাই একটা মালা নেন’’। প্রতিটি মালা বিক্রি করে ১০ টাকা। তারা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ফুটপাতে। রত্না জানায়, তার ছোট ভাই সাকিব এসব মালা বিক্রি করে টিএসসি, হাকিম চত্বর, চারুকলা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা এলাকায়। অভাবের কারণে সে কিংবা তার ছোট ভাই কেউ পড়ালেখা করতে পারছে না। রত্নার মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘‘ আমিও চাই আমার ছাওয়ালেরা পড়ালেখা করুক। তয় আমরা গরিব মানুষ। লেখাপড়া করানোর সাধ্যি আমাগো নাই’’।

        
                শিশু রত্না কাজ করছেন মায়ের সাথে। বাংলা একাডেমীর সামনে থেকে তোলা ছবি



আলিফ পরিবহণের হেল্পার সুমন (১২)। কাজ করে ছয় মাস ধরে। বাসে যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া তুলে। কখনও চালককে সংকেত দেয় ‘ওস্তাদ, বাঁয়ে প্লাস্টিক’। আবার কখনও যাত্রী ওঠানামার সময় চালককে সংকেত দেয়। মিরপুর থেকে বনশ্রী পর্যন্ত যায় এ পরিবহণ। ভাড়া তুলতে তুলতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে যায় সুমন। শুনতে হয় চালকের ধমক। ঢাকার অনেক পরিবহণেরই চিত্র এটি।

                   বাস ভাড়া তুলতে গিয়ে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে সুমন

শিশুশ্রম ও আইন

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯) এবং আইএলও কনভেনশন ১৮২ (১৯৯৯) অনুযায়ী আঠারো (১৮) বছরের কম বয়সী সকল বাংলাদেশী ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে এবং চৌদ্দ (১৪) থেকে আঠারো (১৮) বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে কিশোর/কিশোরী হিসেবে গন্য করা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ এবং ২০- এ শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
বাংলাাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী যাদের বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি তাদেরকে শিশু বলা হয়। এই আইনে উল্লেখ করা হয়েছে যে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত ১৪ বছরের কম বয়সের কোন শিশুকে কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না। আর্টিকেল ৪৪-এ বলা হয়েছে ১২ বছরের শিশুকে কেবল সেসব হালকা কাজেই নিয়োগ দেয়া যাবে, যেখানে তাদের কোন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে না এবং যা তাদের শিক্ষা গ্রহণে বিঘ্ন ঘটাবে না। তবে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮-এ বলা হয়েছে, কেউ যদি শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে, তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোররা হালকা কাজ করতে পারবে।
প্রচলিত আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে কাজে নিয়োজিত সকল শ্রমিকই শিশু শ্রমিক। বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত্য অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল ক্ষেত্রে শিশুর জন্য শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর এবং শিশুর প্রয়োজন ও অধিকারের সঙ্গে সামজ্ঞস্যহীন বঞ্চনামূলক শ্রমই শিশু শ্রম

শিশুশ্রমে ব্যহত হচ্ছে উন্নয়ন

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শিশুশ্রম সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। অথচ বাংলাদেশ সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
শিশুশ্রম যেমন শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে, তেমনি সৃষ্টি করছে নানাবিধ সামাজিক সমস্যার। এর ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক সুস্থ বিকাশের ধারা। সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শিশুশ্রম প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি কম বয়সে কাজে আসাতে তার অর্জিত দক্ষতা দীর্ঘ মেয়াদে কাজে লাগে না। অল্প বয়সে শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার ফলে উপযুক্ত শিক্ষা ও পুষ্টির অভাবে দীর্ঘমেয়াদে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‘শিশু শ্রমিকেরা একদিকে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যদিকে খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ পায় না। এতে কাজে একঘেয়েমিতা আসে ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। ফলে শিশু শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন কম হয় এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের জাতীয় উৎপাদনে’’।
শিশুশ্রম কেবল ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে না, বরং মানব সম্পদ উন্নয়নেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শিশুদের উন্নয়নের সার্বিক কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.