বাড়ির আঙ্গিনায় চা চাষ!
বাড়ির সামনে ১৬ শতক সুপারি বাগান। গাছে গাছে কাঁচা-পাকা থোকা থোকা সুপারি। এর মাঝেই চা চাষ করেছেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার
ক্ষুদ্র চা চাষী সরওয়ার হোসেন। চা গাছে নতুন নতুন কুড়ি। সবুজ ও মসৃণ। এই মসৃণ পাতায়
মসৃণ হয়েছে সরওয়ার রহমানের জীবনও। ঘুরেছে ভাগ্যের চাকা। পাঁচ বছর ধরেই এ বাগানে
শ্রম দিচ্ছেন তিনি। বাগানটি থেকে প্রতি ৪০ দিন পর পর ২০০ কেজিরও বেশি চা পাতা
সংগ্রহ করেন। সুপারি বাগানসহ মোট ৮৯ শতক জমিতে চা চাষ করেন তিনি। এ থেকে প্রতিবারে
তার আয় হয় ৩৬ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
শুধু সরওয়ার রহমান নন, তার মতো তেঁতুলিয়া পঞ্চগড় উপজেলার অনেকের ভাগ্যই খুলেছে।
পঞ্চগড়ে চা চাষ বেশি দিন আগের কথা নয়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ও
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে সমতল ভূমিতে চা চাষের সম্ভাবনার
কথা বলেছিলেন। এর পর থেকেই পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলামের চেষ্টায়
স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয় পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ। প্রথমদিকে
টবে, পরে পতিত জমিতে বাড়তে থাকে চা চাষ। সেই সফলতা থেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাড়তে
থাকে চা চাষের পরিধি। প্রথম দিকে ক্ষুদ্র পর্যায়ে শুরু হলেও ২০০১ সালে তেতুঁলিয়া
টি কোম্পানি এবং পরে কাজী অ্যান্ড কাজী টি স্টেটসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি বড় পর্যায়ে
চা চাষ শুরু করে। বর্তমানে এই চা-চাষ সম্প্রসারিত হয়ে সমতল ভূমিতে চা চাষের
স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে পুরো পঞ্চগড় জেলা।
এখানে চা চাষ এত জনপ্রিয় হওয়ার পেছনের কারণগুলো জানালেন পঞ্চ
গড় চা বোর্ডের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আল মামুন। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া চা
চাষের জন্য খুবই উপযোগী। চারা রোপনের ১-২ বছরের মধ্যে চা পাতা
সংগ্রহ করা যায়। একবার চারা লাগালে অন্তত ৫০-৬০ বছর ফলন পাওয়া যায়। প্রতিবার
রোপনের ঝামেলা নাই। তাই খরচ ও কম। পরিচর্যাও কম লাগে। একর প্রতি বছরে কাঁচা পাতা বিক্রি
করে ২-৩ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
এখানকার চা চাষের অন্যতম দিক হচ্ছে ক্ষুদ্র চাষী পর্যায়ে
চা চাষ। পঞ্চগড় চা বোর্ডের তথ্য মতে,
এখানে নিবন্ধিত ক্ষুদ্র চা চাষী ৫৯২ জন। এদের উৎপাদিত
কাঁচা চা পাতার পরিমাণ ৯৫,৫৬,৫৮৫
কেজি যা পঞ্চগড়ে উৎপাদিত মোট চায়ের প্রায় ৬০ শতাংশ।
![]() |
পঞ্চগড় সদর উপজেলার সোনাপাতিলা এলাকার চা-চাষি মতিয়ার
রহমান বলেন, আমি ২০০২ সালে ৫ একর জমিতে প্রথম চায়ের চারা রোপন করি। পরে ২০০৫ সালে
তেঁতুলিয়ায় একটি কারখানা স্থাপন হওয়ার পর সেখানে কাঁচা চা পাতা সরবরাহ শুরু করি।
বর্তমানে আমার ৪৫ একর জমিতে চা বাগান রয়েছে। এই চা চাষে আমার পরিবার এবং আমার
এলাকার চা শ্রমিকদের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। একসময় আমাদের সবুজ চা পাতা
বিক্রি করতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হতো, এখন সেটা নেই। এখন কারখানার লোকজন বাগান
থেকেই পাতা নিয়ে যাচ্ছেন।
প্রথমদিকে চা কারখানা কম থাকায় আমাদের ক্ষুদ্র চাষিদের
কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। এখন কারখানার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাষিদের সুদিন ফিরে এসেছে।
এখন কারখানাগুলোই চা চাষের পরিধি বাড়ানোর জন্য নানা রকম সাহায্য সহযোগিতা
করছে।তারা সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করছেন।তিনি নিজেও মৈত্রি নামের একটি
চা কারখানা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন । জানালেন সরওয়ার রহমান।
গত কয়েক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৫
সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৬২ হাজার ২৬ কেজি এবং তা
থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ২৫
লাখ ২১ হাজার ৯২১ কেজি।
২০১৬ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৫
লাখ ৭২ হাজার ৯৩৭ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা
(মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ৩২ লক্ষ ৬ হাজার ৪৬ কেজি।
সবশেষ ২০১৭ সালে সবুজ চা পাতা (কাঁচা) উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি
৫১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৯ কেজি এবং তা থেকে তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন হয়েছে ৫৪ লাখ ৪৬
হাজার ৮১৪ কেজি।
এবার ২০১৮ সালেও গত অর্থবছরের উৎপাদিত চায়ের পরিমাণকে
ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি ও দেশের সবচেয়ে অনুন্নত জেলা পঞ্চগড়
এখন চায়ের সবুজ পাতায় ভরে উঠেছে। সৃষ্টি হয়েছে চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য। আন্তর্জাতিক
মানের চা উৎপাদন হওয়ায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পঞ্চগড়ের চা প্রবেশ করছে আন্তর্জাতিক বাজারে।
জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগানের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় চা প্রক্রিয়াজাতকরণ
কারখানা গড়ে উঠায় সৃষ্টি হয়েছে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান, সেই সঙ্গে উন্নয়ন হয়েছে
আর্থ-সামাজিক অবস্থার। এ শিল্পকে সঠিকভাবে তদারকি করতে পারলে দেশের জাতীয়
অর্থনীতে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে।


No comments